মা কান্না করতে করতে রুমে প্রবেশ করে বললেন, বাবা, তোর মামা তো আমার জমি দখল করে নিয়েছে। উত্তেজিত হয়ে গেল ছেলে। হাতে লাঠি নিয়ে বের হলো। আজ মামাকে পেলে শেষ করে ফেলবে। বহুত জ্বালিয়েছে মামা, আর সুযোগ দেওয়া যায় না। লাঠি নিয়ে মামার বাসার সামনে হাজির। মামি অবস্থা বুঝে বললেন, বাবা, বসো। ঠান্ডা কিছু খাও। মারামারি করলে তোমার ক্ষতি এবং তোমার মামারও ক্ষতি। তোমার মামা যা করছে অন্যায় করছে। মামার সাথে বসো, বুঝাও। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি বুঝিয়েও কাজ না হলে, পরে দেখা যাবে কী করা যায়। ঠান্ডা হলো ভাগ্নে। মামা আসলেন। ভাগ্নে উত্তেজিত হয়ে মামার সাথে কথা বলা শুরু করলেন। মামি ভাগ্নেকে থামিয়ে দিয়ে মামাকে বললেন, জমি দখল করে নেওয়ার কারণে আজ সন্তানও পর হচ্ছে। নিজের যতটুকু আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ।

অন্যের জমি দখল করা অন্যায়। মামা শুনলেন মামির কথা। ভাগ্নেকে বললেন, তোর মাকে বল আমি দখল ছেড়ে দিয়েছি। ভাগ্নের মাথায় একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, যদি আমি মামাকে মারতাম এবং মামাও আমাকে মারতেন। এই মারামারির ফলাফল হয়তো ভালো হতো না। কিন্তু মামির মধ্যস্থতা ও আন্তরিকতার কারণে আজ জমি ফিরে পাওয়া গেল। তার মানে মামলা ও মারামারি ছাড়াও পারিবারিক মধ্যস্থতায় সমস্যার সমাধান হয়। ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিলে পারিবারিক মধ্যস্থতায় সমাধান করার সংকল্প করলো ভাগ্নে। আসলেই কি সব সমস্যার সমাধান পারিবারিক মধ্যস্থতায় হয়? আজ সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
পরিবার কি?
সাধারণ অর্থে পরিবার বলতে বুঝায়, এমন কিছু ব্যক্তির সমষ্টিকে যারা একত্রে বসবাস করে। যাদের মাঝে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আন্তরিক সম্পর্ক থাকে। রক্ত সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং বিয়ের মাধ্যমে তৈরি বন্ধনে আবদ্ধ সামাজিক গোষ্ঠীকে পরিবার বলা হয়। আরও সহজভাবে বললে, বিয়ে এমন সংঘ যেখানে সন্তানসহ এবং সন্তান ছাড়া স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করে।

পারিবারিক সমস্যাগুলো কি?
পারিবারিক সমস্যা নানান রকম এবং নানান কারণে তৈরি হতে পারে। নিচে কয়েকটা বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে।
ভুল বুঝাবুঝি
মোবাইলে কুরআন পড়ছে মেহজাবিন। স্বামী দূর থেকে দেখছে, স্ত্রী মনযোগ দিয়ে মোবাইল দেখছে তো দেখছে। অন্য কোনদিকে তার খেয়াল নেই। স্বামীর মনে ক্ষোভ তৈরি হলো, কেন সে এতক্ষণ মোবাইল দেখবে। এগিয়ে গিয়ে বললো, কেন এতক্ষণ মোবাইল দেখো তোমাকে না নিষেধ করেছি মোবাইল দেখতে; মেহজাবিনকে দিলেন ধমক। মেহজাবিন বলল, কুরআন পড়ছিলাম। স্বামী মেহজাবিনের কথা কানে নিলেন না। নিজের বুঝ নিয়েই থাকলেন। স্বামীর এ ভুল বুঝের কারণে তৈরি হলো দাম্পত্য কলহ।

পারিবারিক সমস্যার অন্যতম উৎস হলো ভুল বুঝাবুঝি। স্ত্রী স্বামীকে এবং স্বামী স্ত্রীকে ভুল বুঝে। বাবা-মা সন্তানকে এবং সন্তান বাবা-মাকে ভুল বুঝে। ভাইবোন একে অপরকে ভুল বুঝে। এভাবে ভুল বুঝাবুঝি থেকে পারিবারিক সমস্যা তৈরি হয়। যে সমস্যা ধীরে ধীরে অনেক বড় হয়ে যায়। এমনকি ভুল বুঝাবুঝি থেকে সৃষ্ট সমস্যা থেকে কখনো কখনো সংসার ভেঙ্গেও যায়।
অর্থনৈতিক সমস্যা
স্ত্রী স্বামীর কাছে অনেক কিছু আশা করে। স্বামীর সেরকম সামর্থ্য না থাকার কারণেস্ত্রীর সব আশা ও শখ পূরণ করতে পারে না। এভাবে ধীরে ধীরে স্ত্রীর মন খারাপ হয়। কেন তার শখ পূরণ করা হচ্ছে না; এসব নিয়ে তৈরি হয় সমস্যা।

অতীত আলোচনা
স্ত্রী খুব মনযোগ দিয়ে সংসার করছে। স্বামীকে ভালোবাসছে। কিন্তু অতীতে হয়তো তার কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো। সে সম্পর্কে কিছু অনৈতিক কাজও সে করেছে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে স্ত্রীর মন খারাপ হয়ে যায়।
অন্যদিকে স্বামী বিয়ের আগে কোনো মেয়ের সাথে অনৈতিক কাজ করেছে। নেশাগ্রস্ত ছিলো। আরও অন্যান্য অন্যায় কাজ করতো। এখন স্বামী ভালোভাবে সংসার করছে। অতীতকে ভুলে গেছে। কিন্তু কোনো কারণে স্ত্রী হয়তো স্বামীর অতীত নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। স্বামীকে ক্ষেপিয়ে দিলো। তৈরি হলো পারিবারিক সমস্যা।
একইভাবে সন্তানকে অতীতের কোনো ভুল ও অন্যায়ের কারণে দোষারোপ করতে থাকা। যে বিষয়ে দোষারোপ করার কারণে সন্তানের মন ভেঙ্গে যায়। বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়।

অবমূল্যায়ন করা
পরিবারের কাউকে বেশি এবং কম কাউকে মূল্যায়ন করলে, তৈরি হয় সমস্যা। মনের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়, কেন আমাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ ক্ষোভ থেকে পরিবারের মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। তাদের সাথে যোগযোগ কমে যায় এবং দূরত্ব তৈরি হয়।
স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে অবমূল্যায়ন করতে থাকলে, সংসারে অশান্তি হয়। এ অশান্তি নিয়ে সংসার করলে মানসিক রোগী হতে হয়। অবমূল্যায়ন বেশি হয়ে গেলে কখনো কখনো স্বামী স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদও ঘটে।
চাকরিজীবী স্ত্রী
স্ত্রী চাকরি করছে, স্বামী তা পছন্দ করে না। স্বামী চায় স্ত্রী বাসায় থাকবে এবং ঘর সামাল দিবে। স্ত্রী তার মতে অটল। তৈরি হয় সমস্যা।এছাড়াও স্বামী চাচ্ছে যে স্ত্রী চাকরি করুক। সাথে সাথে এটাও চাচ্ছে যে, স্ত্রী উপার্জিত অর্থ পরিবারে খরচ করুক। কিন্তু স্ত্রী তার টাকা তার মতো ব্যয় করছেন। এতে করে তৈরি হয় সমস্যা। স্বামী বলে, সংসার কি আমার একার, তোমার না? আমি কেন একলা খরচ করবো, তুমি করছো না কেন?

সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা
বাবা-মা সম্পত্তি রেখে গেছেন। ভাই বোনকে সম্পত্তির ভাগ দিচ্ছে না। বোনের ক্ষমতা থাকলে তা প্রয়োগ করে ভাইয়ের থেকে সম্পত্তি আদায় করছে। ক্ষমতা না থাকলে ভাইয়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করছে। কখনো কখনো সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মারামারিও হচ্ছে। মামলা হচ্ছে। খতম হয়ে যাচ্ছে ভাইবোনের সম্পর্ক।
লেনদেনে এলোমেলো
ভাই বোন থেকে বা বোন ভাই থেকে টাকা ধার নিয়েছে। সে টাকা ফেরত দিচ্ছে না। একইভাবে শ্যালক দুলাভাই থেকে বা শশুরবাড়ির লোকজন জামাই থেকে টাকা নিয়েছে। তা ফেরত পাচ্ছে না। এমন এলোমেলো লেনদেনের কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

অনৈতিক আবদার
স্বামী স্ত্রী থেকে যৌতুক চাওয়া। স্ত্রীর পরিবারের দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে এক দু’বার দেয়। এরপর লেগে যায় ঝামেলা। জামাই কেন বারবার টাকা চায়। কেন জামাইয়ের এত অনৈতিক আবদার। স্বামী স্ত্রীকে চাপ দিতে থাকে, আমাকে আরও যৌতুক দিতে হবে। স্ত্রীর সংসার করার মানসিকতা থাকলে, কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেই সংসার করে। সংসার করার মানসিকতা না থাকলে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। স্বামীর নামে নারী নির্যাতন মামলা করে। এমন অন্যায় আবদারের কারণে ভেঙ্গে যায় অনেক সংসার। তৈরি হয় শত্রুতা।
খোটা দেওয়া
স্বামী স্ত্রীকে খোটা দেওয়া যে, তোমার বাবা মা তোমাকে কিছুই দিলো না। শূন্যহাতে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। অন্যদিকে স্ত্রী স্বামীকে খোটা দেয় ও কথা শোনায়, তুমি তো কিছুই দিতে পারো না আমাকে। আমার ভাই ও মা আমাকে এটা দিয়েছে, এ জাতীয় কথাবার্তা। এমন কথাবার্তার কারণে তৈরি হয় দাম্পত্য কলহ।

সন্তান নিয়ে সমস্যা
সন্তানের নাম কে রাখবে এখান থেকে তৈরি হয় সমস্যা। এরপর সন্তান কোথায় পড়াশোনা করবে না করবে এবং কোথায় বিয়ে করবে, এসব নিয়ে চলতেই থাকে অশান্তি।
পারিবারিক এত সমস্যা ও অশান্তির সমাধান মীমাংসার মাধ্যমে হয় কি অথবা এসব সমস্যা সমাধানের উপায় কি?
- ১. স্বামী স্ত্রী বা ভাইবোন নিজেরা ঠান্ডা মাথায় পারস্পরিক আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা।
- ২. পরিবারের মুরুব্বিদের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা।
- ৩. গ্রাম, পাড়া বা মহল্লার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।

মনে রাখতে হবে, পরিবারের সমস্যা বাইরে বলা বোকামি। নিজেরাই সমাধান করা বুদ্ধিমানের কাজ। সমস্যা সমাধানের জন্য আইনের দ্বারস্থ হতে হলে সমস্যার সমাধান হয়তো হবে। কিন্তু আন্তরিকতা ও ভালোবাসা কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
তথ্যসূত্র: (লেখায় ইংরেজি কনটেন্টের বাংলা সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে)
ছবি- ফ্রিপিক